May 10, 2025, 2:13 am
ড. আমানুর আমান/
আজ ২৫শে বৈশাখ, বাংলা সাহিত্যের বিশ্ববরণীয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৪তম জন্মবার্ষিকী। এ বছর, এই দিনটি জাতীয় পর্যায়ে উদযাপিত হচ্ছে। কবির ঐতিহাসিক বাসভবন শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে তিনদিনব্যাপী রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যার সঙ্গে থাকছে একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ মেলা।
এই উৎসবের সূচনা হয় বৃহস্পতিবার, ৮ই মে, এবং এটি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহায়তায় এবং কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত হবে। এ বছরের কেন্দ্রীয় প্রতিপাদ্য হচ্ছে—“রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশ”।
উৎসবে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকবে, যাতে শিল্পকলা একাডেমি এবং স্থানীয় শিল্পীরা অংশগ্রহণ করবেন।
এক সংযুক্ত বিন্যাস/
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বাংলা সাহিত্য একে অপরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত—এরা একে অপরকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। বাংলা সাহিত্যের সকল শাখাই তাঁর রচনার দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে। তিনি বাংলা সাহিত্যের একক প্রতীক, যিনি একটি সম্পূর্ণ অধ্যায়কে ধারণ করেন—একটি অধ্যায় যা বাংলা সাহিত্যকে মহিমার চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছে।
এই বিন্যাস এমনই যে, তিনি বাংলার কবি, বাংলার মানুষের কণ্ঠস্বর। তবুও, তিনি কেবল জাতিগত সীমানায় সীমাবদ্ধ নন—তিনি সত্যিকার অর্থেই বিশ্বকবি। তাঁর কবিতাই তাঁকে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি এনে দেয়। ১৯১৩ সালে, তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রথম এশীয় হন—যা তাঁর রচনার চিরকালীন এবং বিশ্বজনীন আবেদনকে স্বীকৃতি দেয়।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যচিন্তা গভীর মানবতাবাদে ও একটি বৃহত্তর অস্তিত্বের সঙ্গে সত্তার সংহতিতে প্রতিষ্ঠিত—প্রকৃতি, জীবন ও মহাবিশ্বের সঙ্গে মিলনের এক অন্তর্নিহিত অন্বেষা। তাঁর সৃজনশীলতা একক কোনো ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়; কল্পনা ও শিল্পের বিস্তৃত পরিসরে তিনি অবাধ বিচরণ করেছেন।
রবীন্দ্রনাথকে একজন বহুমাত্রিক প্রতিভা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তিনি কবি, সুরকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, প্রবন্ধকার, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ এবং সমাজসংস্কারক।
রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবনই ছিল তাঁর সৃষ্টিশীলতার উৎস। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সাহিত্যিক চেতনার বিবর্তন ঘটে। আত্মবিশ্লেষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে তিনি সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা, দার্শনিকতা ও বিজ্ঞানের পরিবর্তনকে আত্মস্থ করেছেন। ফলে তাঁর রচনায় বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকে ক্রমাগত পরিবর্তন এসেছে। এর ফলেই তাঁর কবিতা, গান, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, নৃত্যনাট্য, ভ্রমণকাহিনি, চিঠিপত্র ও বক্তৃতাগুলি অসংখ্য পরিমাণে সৃষ্টি হয়েছে—বাংলাদেশে ও বিদেশে।
যদিও সময় ও পরিপ্রেক্ষিত বদলেছে, রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন থেকে তিনি বিচ্যুত হননি। তাঁর সৃষ্টিশীলতা ছিল একাধারে পরিবর্তনশীল ও অভিযোজনক্ষম।
রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র তাঁর সময়ের কবি ছিলেন না—তিনি সময়কে অতিক্রম করেছেন। তাঁর আবির্ভাব বাংলা কবিতার বিবর্তনের এক নির্ধারক মুহূর্ত।
কবিতা/
রবীন্দ্রনাথের কবিতা বৈচিত্র্যময়—কখনও শাস্ত্রীয় ও গাম্ভীর্যপূর্ণ, কখনও হাস্যরসাত্মক, কখনও গভীর দর্শনভিত্তিক, আবার কখনও প্রফুল্লতায় পরিপূর্ণ। তাঁর কবিতার মূল উৎস ১৫-১৬ শতকের বৈষ্ণব পদাবলী ধারায় খুঁজে পাওয়া যায়। উপনিষদের ঋষিদের, বিশেষ করে ব্যাসদেবের প্রভাব তাঁর কাব্যে প্রকট। সুফি সাধক কবীরের আধ্যাত্মিকতা এবং রামপ্রসাদ সেনের ভক্তিভাবও তাঁর কবিতাকে গঠন করেছে।
শিলাইদহে অবস্থানকালে তিনি বাংলার লোকসঙ্গীত, বিশেষ করে বাউল সাধকদের সংস্পর্শে এসে তাঁর কাব্যধারায় নতুন মাত্রা যোগ করেন। লালন শাহের মতো কিংবদন্তি বাউলের প্রভাব তাঁর রচনায় গভীর ছাপ ফেলে। বাউল গান পুনরাবিষ্কার ও জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
এই সময়েই তিনি বাউল গানের “মনের মানুষ” ধারণাকে আত্মস্থ করে জীবনের আধ্যাত্মিক প্রকৃতিকে অন্বেষণ করেন। মানবচরিত্র ও প্রকৃতির মধ্যে আবেগঘন ও নাটকীয় যোগসূত্রের মাধ্যমে তিনি ঈশ্বরের সন্ধান করেন। এই আধ্যাত্মিক ও গীতল শৈলী তিনি “ভানুসিংহ” ছদ্মনামে রচিত রাধা-কৃষ্ণ প্রেমকাব্যেও ব্যবহার করেন। তিনি এই কবিতাগুলিকে প্রায় সত্তর বছর ধরে বারবার সংশোধন করেছেন।
সঙ্গীত/
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীল উত্তরাধিকারের সবচেয়ে স্থায়ী ও প্রভাবশালী দিক তাঁর সঙ্গীত। তিনি প্রায় ২৫০০টি গান রচনা করেছেন, যা “রবীন্দ্রসঙ্গীত” নামে পরিচিত। এটি বাঙালি সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর সঙ্গীত ও সাহিত্য একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত; অনেক কবিতা গান হয়ে উঠেছে, আবার গানগুলো উপন্যাস, গল্প ও নাটকে আবেগ ও বর্ণনার মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।
তাঁর গানের ভিত্তি মূলত হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঠুমরি ধারার ওপর নির্মিত হলেও, আবেগ ও রীতিতে বৈচিত্র্য অসীম—ব্রাহ্ম ভজন থেকে শুরু করে কোমল প্রেমের সুর পর্যন্ত।
রবীন্দ্রসঙ্গীতে রাগের শুদ্ধতা যেমন দেখা যায়, তেমনি ধবংঃযবঃরপ প্রয়োজনে একাধিক রাগ মিশিয়ে গানের সুর তৈরি করাও লক্ষ্যণীয়।
তাঁর সঙ্গীতে হিন্দুস্তানি ও কর্ণাটক শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, বাংলা লোকসুর এবং ইংরেজি ও স্কটিশ লোকগানের প্রভাবও রয়েছে। ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর সংকলন অনুসারে, রবীন্দ্রনাথের ২৩৪টি গান বিভিন্ন সঙ্গীত রচনার দ্বারা অনুপ্রাণিত।
নিজের কবিতার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ বেদের স্তোত্র, বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার বড়াল, ও সুকুমার রায়ের রচনার জন্যও সুর রচনা করেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তিনি ভারতের জাতীয় সংগীত “বন্দে মাতরম”-এর সুরও দিয়েছেন।
তাঁর প্রভাব বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী যেমন—বিলায়েত খান, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ও আমজাদ আলি খানের মতো যন্ত্রসংগীতজ্ঞদের উপরও পড়ে, যারা রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের আবেগঘনতা ও কাব্যিক সৌন্দর্য বাঙালি সমাজে এক অপরিহার্য আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে। ঞযব গড়ফবৎহ জবারবি একবার লিখেছিল:
“বাংলার এমন অল্প ঘর আছে যেখানে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া হয় না, বা অন্তত চেষ্টা করা হয় না… এমনকি অশিক্ষিত গ্রামবাসীরাও তাঁর গান গায়।”
রবীন্দ্রনাথই একমাত্র ব্যক্তি যিনি দুইটি দেশের জাতীয় সংগীত রচনা করেছেন: বাংলাদেশের “আমার সোনার বাংলা” এবং ভারতের “জন গণ মন”।
Leave a Reply